কেন বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড গুরুত্বপূর্ণ?

৫৯তম আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের উদ্বোধনীতে বাংলাদেশের খুদে গণিতবিদেরা। গতকাল রোমানিয়ার ক্লুজ নাপোকা শহরে।  ছবি: প্রথম আলো
৫৯তম আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের উদ্বোধনীতে বাংলাদেশের খুদে গণিতবিদেরা। গতকাল রোমানিয়ার ক্লুজ নাপোকা শহরে। ছবি: প্রথম আলো

আজ (সোমবার, ৯ জুলাই) আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে (আইএমও) অংশগ্রহণ করবে বাংলাদেশ। এটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে রোমানিয়ার ক্লজ-নাপোকাতে। আজ থেকে ঠিক ৫৯ বছর আগে প্রথম আইএমও প্রতিযোগিতাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল এই রোমানিয়াতেই।

অনেকেই বলতে পারেন, ‘বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের বিশেষত্ব কী?’ প্রথমত, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড (বিডিএমও) হলো তরুণদের দ্বারা পরিচালিত একটি সংগঠন। এটি এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যেখানে শিক্ষক বা প্রশিক্ষক নিয়োগ করা হয় উচ্চমাত্রার কারিগরি দক্ষতার ভিত্তিতে এবং শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে যাঁদের ধারণা একবিংশ শতাব্দীর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
গণিত অলিম্পিয়াড দেশের সেরা শিক্ষার্থীদের খুঁজে বের করতে সক্ষম। বিগত কয়েক বছরে বিডিএমও জাতীয় দলের প্রাপ্তি অত্যন্ত চমকপ্রদ। গত বছর আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে ১১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ২৬তম। কানাডা ও জার্মানির মতো দেশকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ এ স্থান অর্জন করে। বাংলাদেশ ছিল এশিয়ার মধ্যে সেরা, উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে সেরা, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ইরান ও তাজিকিস্তানের মতো উন্নয়নশীল দেশের কাতারে। দ্বিতীয়বারের মতো সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট অর্জনকারী ছিল আমাদের একজন। তাঁর নাম আসিফ এলাহী।

বাংলাদেশের এই চমকপ্রদ অর্জনে যুক্তরাজ্যের জাতীয় দলের কোচ জিওফ স্মিথ বিহ্বল হয়ে আমাকে বলেছিলেন, ‘এ বছর তোমরা আলাদাভাবে কী করলে?’ একইভাবে ভারতের জাতীয় দলের কোচ, যিনি কিনা কয়েক বছর আগে আমাকে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ কখনো ভারতকে হারাতে পারবে না।’ সেই তিনি বলেছিলেন, ‘তোমরা সেরা। তোমরা আমাদের ওপরে অবস্থান করছ।’

বাংলাদেশ ২০১৭ সালে ১১১ পয়েন্ট অর্জন করে এবং ভারত অর্জন করে ৯০ পয়েন্ট। পয়েন্টের এ তফাতটি ছিল নেপালের জাতীয় স্কোরের তুলনায় সাত গুণ। নেপাল সব মিলিয়ে পেয়েছিল ৩ পয়েন্ট। আমাদের অর্জনের গুরুত্ব বোঝাও যায় যখন অন্যান্য দেশের স্কোরের সঙ্গে আমাদের তুলনা করি। মিয়ানমার সেবার পেয়েছিল ১৫ পয়েন্ট এবং পাকিস্তান পেয়েছিল ৫৮ পয়েন্ট।

বাংলাদেশে যাঁরা আন্তর্জাতিক শিক্ষাঙ্গনে আমাদের এই প্রাপ্তির তাৎপর্য বুঝতে সক্ষম ছিলেন, তাঁদের কাছেও এটি ছিল কল্পনার বাইরে। অধ্যাপক কায়কোবাদ, যিনি কিনা বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে একেবারে প্রথম সারির একজন মানুষ, তিনিও এই অর্জনে ভাষা হারিয়ে ফেলেন। বিশিষ্ট গণিতবিদ ওহাইও স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সালেহ তানভীর আমাদের এ সাফল্যে আবেগে আপ্লুত হয়ে ওঠেন। প্রিন্সটনের অধ্যাপক জাহিদ হাসান আমাদের অর্জনে ছিলেন আনন্দিত। আমার বাবা, অর্থনীতির সাবেক অধ্যাপক বদিউল আলম মজুমদার আমাদের অর্জনে কেঁদে ফেলেন।

এ থেকে যা বোঝা যায়, যদি সঠিক পন্থা অবলম্বন করে তথাকথিত শিক্ষাগত অহংকারের চেয়ে গুণকে বেশি মর্যাদা দেওয়া হয়, তাহলে আমরা বিশ্বসেরা হতে পারি। এটা বিস্ময়ের কিছু না। বাংলাদেশের মতো একটি দেশে যদি শেখাকে মর্যাদার আসনে স্থান দেওয়া হয়, তাহলে ১৬ কোটি মানুষের দেশে এ রকম অর্জন খুবই প্রত্যাশিত একটি ব্যাপার।

বিডিএমওর এই শিক্ষার্থীদের ভালো করার পেছনের কারণ হলো, এই শিক্ষার্থীরা এখনো বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষাব্যবস্থার কাঠামোগত ত্রুটির শিকার হননি। গণিত অলিম্পিয়াডের শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার জন্য এমআইটি, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো নামকরা জায়গায় নিরহংকারী পরিবেশে পড়তে যাওয়ার সুযোগ পান।

আমি ছোট পরিসরে এই চর্চাকে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে বাস্তবায়ন করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। ফল হিসেবে, সমগ্র দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে আমাদের ক্লাসে যোগদান করছেন। এ ছাড়া আমার শিক্ষার্থীরা তাদের উচ্চতর শিক্ষার জন্য বিশ্বের সেরা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যাচ্ছে, এমন সব প্রতিষ্ঠান যেগুলোতে যাওয়া একজন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর জন্য অকল্পনীয় ছিল। ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়, ওয়াটারলু বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষার্থীরা কাজ করছে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা থেকে শুরু করে মেশিন লার্নিংয়ের মতো বিষয়ে। এসব শিক্ষার্থীর মধ্যে কয়েকজন বাংলাদেশে প্রথম ব্লক চেইন নিয়ে গবেষণামূলক কাজ করে, যার মুখ্য বিষয় ছিল ফাইন্যান্সে মেশিন লার্নিংয়ের ব্যবহার। এ ছাড়া কয়েকজন কাজ করছে স্ট্রিং থিওরি ব্যবহার করে মহাবিশ্বের শুরুর দিকের মডেলগুলোর অনুসন্ধান করা নিয়ে। আমাদের উচ্চশিক্ষাব্যবস্থায় গণিত অলিম্পিয়াডের এই চর্চা আরোপ করলে যে কী পরিমাণ সাফল্য অর্জন করা সম্ভব, এসব স্বপ্রণোদিত শিক্ষার্থীরাই তার উদাহরণ।

প্রার্থনা করি, ১৩ জুলাই যখন আইএমওর ফলাফল ঘোষণা করা হবে, তখন যেন আমরা বিজয়ী হিসেবে দেশের পতাকা ওড়াতে পারি।

মাহবুব মজুমদার ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের ন্যাশনাল কোচ