বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০
The Daily Ittefaq

বিশেষজ্ঞমত

'আমার করোনা হবে না!'-এই বিশ্বাস ক্রমেই বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে

আপডেট : ২৩ এপ্রিল ২০২০, ২১:১১

আট দিন পর গত ১৯ এপ্রিল জয়দেবপুর বাজারে গিয়েছিলাম সকাল ১০ টার পর জরুরি খাদ্য সামগ্রী কিনতে যেহেতু দোকান খোলা থাকবে ১২ টা পর্যন্ত। বাজারে গিয়ে আমি আমি অবাক, আজকে বাজারে যে কোন স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক বেশি লোকের সমাগম হয়েছে। ১২ টার মধ্যে বাজার করার জন্য সবাই এত ভিড় জমিয়েছে। কেউ সামাজিক দূরত্ব মানছে না বা মানতে পারছে না। মাছ কাটাতে গিয়ে পরিচিত কয়েকজনের সাথে দেখা । জিজ্ঞেস করলাম  সামাজিক দূরত্ব না মানার কারণ কি? মানুষ একটু ধৈর্য ধরলেই তো অনেকটাই সামাজিক দূরত্ব মানা সম্ভব। কথা শেষ করতে না করতেই বেশ কয়েকবার অন্য মানুষের গায়ের ধাক্কা খেতে হলো। উত্তর মিলে গেল, বলল, 'দেখলেন কেন সামাজিক দূরত্ব মানা সম্ভব হচ্ছে না। 'তাদের পরের কথায় হতবাক না হয়ে আর পারলাম না। অনেক আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল, 'আমাদের করোনা হবে না'। কারণ কি? জবাব হলো: ১। বাংলাদেশের মানুষ যা খাওয়া-দাওয়া করে হজম করে পৃথিবীর আর কোনো জাতি সেটা পারবে না । ২। বাংলাদেশ গরমের দেশ, আর গরমে করোনা হয় না। আমি প্রশ্ন করলাম, 'তাহলে আমাদের দেশে কেন করোনা হচ্ছে?'

এর উত্তর হলো, 'দেখবেন এই করোনা ফরোনা বেশি বাড়বে না'। আমি আর কথা না বাড়িয়ে, যেহেতু যে কাজের অপেক্ষায় ছিলাম, সেই কাজ শেষ হওয়ায় চলে আসলাম আর বললাম, 'খুবই আশার কথা। আমি ও মনে প্রাণে চাই যে আমাদের দেশেও যেন আর কোন ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত না হয়।'

বাজার শেষ করে আসার সময় গলিতে দেখি ২০-২৫ জন যুবক গাদা-গাদি করে বসে আড্ডা দিচ্ছে। সামাজিক দূরত্ব মোটেও মানছে না কেউ। মাত্র ৩ জনের মাস্ক আছে। মজার ব্যাপার হলো মাস্ক পরে গলা-গলি ধরে দাঁড়িয়ে আছে । আমি নিজেকে সংবরণ করতে না পেরে, ওদের কাছে গেলাম। যথারীতি সামাজিক দূরত্ব ও করোনায় কি করনীয় সেটা নিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করলাম । এবং অনুরোধ করলাম সবাইকে যার যার বাড়িতে থাকতে। আশ্চর্য হলাম, একটু আগে বাজারে যা শুনে এলাম সেই একই কথা “ আমাদের করোনা হবে না”। অন্য একজন বলে উঠলো, আল্লাহ্‌ করোনা পাঠাইছে, আল্লাহ্‌ই এর বিহিত করবে। আল্লাহ্‌ যদি চায়, আমরা ঘরে থাকলেও করোনা হবে, আবার বাইরে থাকলেও হবে । তখন আমি সাধ্যমত চেষ্টা করলাম তাদের বোঝানোর । যুক্তি তুলে ধরলাম নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের ভয়াবহতা সহ। আমিও ছাড়বার পাত্র নয়। অবশেষে প্রায় ১ ঘণ্টা পর সবাইকে মাস্ক ও স্যানিটাইজার দেবার পর তারা সবাই আমার ওখান থেকে চলে গেল। আমি জানি ওরা হয়তো আবার আসবে।

বাসায় আসতে আসতে মনে হলো আমাদের দেশের সকল রাজনৈতিক দল ও নেতাদের একই ভূমিকা নেয়া প্রয়োজন। মনে পড়লো বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ইসলামই বিশ্বাস করেন বেগম খালেদা জিয়া যেহেতু এখন মুক্ত সেহেতু দেশে করোনা হবে না”। তাই হয়তো বিএনপিকে এই মহামারীতে মানুষের পাশে দেখা যাচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে গত ২০ এপ্রিল, ২০২০ তারিখের লেখায় যেহেতু বিস্তারিত লিখেছি, তাই এখন আর কিছু বলছি না। এখন রাজনৈতিক দল ও নেতাদের ভূমিকা নিয়ে বলা প্রয়োজন। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানকারী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের উপর মানুষের প্রত্যাশা যেমন অনেক বেশি এবং এই দল ও দলের নেতাকর্মীরা জীবনবাজি রেখে সকল দুর্যোগে জনগণের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে।  তাদের সাধ্যমত ত্রাণসহ  সকল সেবা পৌঁছে দিচ্ছে জনগণের দোরগোড়ায়। নিজের সকল পরিচয় ভুলে জনগণের সেবক হিসাবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, কৃষকলীগ, শ্রমিকলীগ, যুবলীগ এবং বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এই মুহূর্তে কৃষকের ফসল কেটে ঘরে তুলে দিচ্ছেন। সারাদেশে অসংখ্য জনপ্রতিনিধি, নেতা-কর্মীদের এই সহযোগিতা মানুষ মনে রাখবে চিরকাল। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ-সংগঠন ছাড়াও এই ক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছে বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক, বিভিন্ন পেশাজীবী ও সামাজিক সংগঠন সমূহ। ব্যক্তিগতভাবেও এই দুর্দিনে জনগণের পাশে আছে তারা।

একটি খবর আমাকে দারুণ আলোড়িত করেছে। শেরপুর এর ভিক্ষুক সারা জীবন ভিক্ষা করে স্বপ্ন দেখতেন একটি ঘর বানানোর। কিন্তু নিজের কষ্টের তিল তিল করে জমা করা ১০ হাজার টাকা তুলে দিলেন এই মহামারিতে দুস্থ মানুষের সেবায়। অর্থনৈতিকভাবে ভিক্ষুক হলেও মানসিকভাবে উনি অনেক বড়মনের পরিচয় দিয়েছেন। আমাদের দেশের অন্যতম এনজিও কর্ণধার, কোটি কোটি টাকার মালিক অন্যতম নোবেল বিজয়ী ডঃ ইউনুস কি এখনো লজ্জিত হবেন না? বাংলাদেশের সকল ব্যবসা অত্যন্ত খারাপ চললেও তার গ্রামীণ কমিউনিকেশনের ব্যবসার প্রসার মারাত্মকভাবে বেড়েছে। প্রায় প্রত্যেকেরই ফোনে কথা বলা ও মোবাইল ডেটা এবং ইন্টারনেট ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। যে করোনার কারণে তাদের হাজার হাজার কোটি টাকার এই মুনাফা সেখান থেকে সামান্য অংশ নিয়ে জনগণের পাশে দাঁড়াতে পারেন না? নাকি এখনো সুযোগের অপেক্ষায় আছেন কখন জনগণের দোহাই দিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলা যাবে?

আপনাদের কাছে অনুরোধ দয়া করে এই মুহূর্তে জনগণের পাশে থাকুন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনাগুলো জনগণের কাছে তুলে ধরুন। আপনারা এবং আপনাদের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যদি কিছু লোক সচেতন হয় তবুও অনেক বড় উপকার হবে তা নাহলে ঘরে বসে দেখুন আর সমীক্ষা করুন, রিপোর্ট প্রকাশ করুন বিভিন্ন বিদেশি গণমাধ্যমে। তবে ১৯১৮ এর জানুয়ারি থেকে ১৯২০ এর ডিসেম্বর পর্যন্ত স্প্যানিশ ফ্লুতে মারা যাওয়া পাঁচ কোটিরও অধিক মৃত্যুর ন্যায় আপনাদের সমীক্ষা ও পর্যবেক্ষণে মশগুল থাকতে হবে। তবে যদি করোনা থেকে ততদিনে নিজে রক্ষা পান।

সর্বসাধারণকে বলছি আমার করোনা হবে না এটা মনে করে এত রিল্যাক্স থাকবেন না। এই চিন্তাই কিন্তু আপনাকে করোনার দিকে ঠেলে দেবে। আপনাদের কাছে অনুরোধ ঘরে থাকুন। করোনা ভাইরাস এর প্রতিরোধের উপায় গুলো মেনে চলুন নিজে বাঁচুন, অন্যকে বাঁচান। আসুন সবাই মিলে সরকারের পাশে দাঁড়াই, জনগণকে ও দেশকে বাঁচাই।

লেখক: অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।

ইত্তেফাক/আরএ