ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বীরেন মুখার্জী

কাজী নজরুলের সম্পাদকসত্তা

প্রকাশিত: ০৬:৫৯, ২৬ আগস্ট ২০১৬

কাজী নজরুলের সম্পাদকসত্তা

কবিতা কিংবা গান-ই নয়, সাংবাদিকতার মাধ্যমেও কাজী নজরুল ইসলাম বিপ্লবী ধারার সূচনা করেন। অত্যাচারী বিদেশী শাসক, দেশীয় তোষামোদকারী ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে শক্তিশালী ও শাণিত সম্পাদকীয় লিখে শাসকদের ভিত কাঁপিয়ে তোলেন। ইংরেজ শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে ভারতজুড়ে যে গণবিপ্লব সংগঠিত হয়, তা শাণিত ও বেগবান করতে কাজী নজরুল ইসলাম ‘নবযুগ’ পত্রিকার মাধ্যমে সাংবাদিকতা জগতে আবির্ভূত হন। অনস্বীকার্য যে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ ভারতবর্ষের প্রেক্ষাপটে গণজাগরণ সৃষ্টিসহ ব্রিটিশ শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। ইংরেজদের অন্যায় শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালীর গণজাগরণ সৃষ্টি এবং গণবিপ্লবে মদদ দেয়ার অভিযোগে অধিকাংশ পত্র-পত্রিকা রাজরোষেরও শিকার হয়। কিছু কিছু পত্রিকার প্রকাশনাও বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপরও থেমে থাকেননি নজরুল। কারণ, বাঙালীর আর্থ-সামাজিক, মানবিক বিপর্যয়ে গভীরভাবে মর্মাহত নজরুল মানসে বাঙালীর পরাধীনতা থেকে মুক্তির দ্যোতনা ক্রিয়াশীল ছিল। তিনি শোষণের শৃঙ্খল ভাঙার প্রত্যয়ে যেমন অগ্নিঝরা কবিতা লিখেছেন তেমনি সাংবাদিকতার মাধ্যমে গণমানুষকে একত্রিত করতে সম্পাদকীয় লিখেছেন। রাশিয়ার নবেম্বর বিপ্লব, তুরস্কের তরুণ তুর্কীদের অভিযান এবং আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতা সংগ্রাম কাজী নজরুল ইসলামকে সাংবাদিকতায় অনুপ্রাণিত করে। কবিতায় বিদ্রোহী ধারা সূচনার পর সাংবাদিকতার ইতিহাসেও তিনি দুঃসাহসিক, বিপ্লবী ধারার সংযোজন ঘটান। সমকালীন রাজনীতিমনস্ক যুগচিন্তাকে আশ্রয় করে ভাষার হুল ফোটাতেন তিনি। সাংবাদিক হিসেবে তার নিষ্ঠা, একাগ্রতা ও প্রতিভা মূল্যায়ন করতে গিয়ে নজরুল সহকর্মী মুজফ্ফর আহমদ ‘স্মৃতিকথা’য় উল্লেখ করেনÑ ‘১৯২০ সালের ১২ জুলাই তারিখে কাজী নজরুল ইসলাম ও আমার সম্পাদনায় ‘নবযুগ’ বার হলো। নিশ্চয়ই নজরুলের জোরালো লেখার গুণে প্রথম দিনেই কাগজ জনপ্রিয়তা লাভ করল।... দৈনিক কাগজে লেখার অভিজ্ঞতা আমাদের একজনেরও ছিল না। নজরুল ইসলাম কোন দিন কোন দৈনিক কাগজের অফিসেও ঢোকেনি। তবু সে বড় বড় সংবাদগুলো পড়ে সেগুলোকে খুব সংক্ষিপ্তাকারে নিজের ভাষায় লিখে ফেলতে লাগল। তা না হলে কাগজে সংবাদের স্থান হয় না। নজরুলকে বড় বড় সংবাদের সংক্ষেপণ করতে দেখে আমরা আশ্চর্য হয়ে যেতাম। ঝানু সাংবাদিকরাও এই কৌশল আয়ত্ত করতে হিমশিম খেয়ে যান। তারপরে নজরুলের দেয়া হেডিংয়ের জন্যও ‘নবযুগ’ জনপ্রিয়তা লাভ করে।’ রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা থেকে শুরু করে সাহিত্য বিকাশ ও গণজাগরণ সৃষ্টির ক্ষেত্রে সংবাদপত্রের ভূমিকা কোন সময়ই উপেক্ষণীয় নয়। জনগণকে দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ ও বিপ্লবী জাগরণ তৈরি এবং যে কোন আন্দোলনে সাধারণ জনতাকে সম্পৃক্ত করতে সংবাদপত্রের রয়েছে সোনালি অতীত। কবিতা-গানে, নজরুল যেমন তার মনোভাবকে অকুণ্ঠভাবে প্রকাশ করতে ভয় পাননি, সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও তেমনি তিনি জনতার কাতারে থেকেছেন। অধীনতার নাগপাশ ছিন্ন করে তিনি স্বাধীনতার বাণী প্রচার করেছেন। এর অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ ইংরেজী শাসকের কারাগারে তাকে কারাভোগ করতে হয়েছে। এরপরও নজরুল ইসলাম শাসকশ্রেণীর সঙ্গে কোনওরূপ আপোস করেননি। তার কবি জীবন যেমন অখ-িত তেমনি সাংবাদিক জীবনও অবিচ্ছিন্ন, অনমনীয় ও আপোসহীন সংগ্রামের এক উজ্জ্বল ইতিহাস। ১৯২০ সালের ১২ জুলাই প্রকাশিত সান্ধ্য দৈনিক ‘নবযুগ’ প্রকাশ ও নজরুলের সাংবাদিকতার উৎসে ভারতের স্বাধীনতার কাক্সক্ষা ও আন্তর্জাতিকতাবাদী চেতনা প্রধান হয়ে আছে। ১৯১৫ সালে ভারতব্যাপী সশস্ত্র বিদ্রোহের এক পরিকল্পনা করে জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ বিপ্লবীরা। এ পরিকল্পনা কার্যকর না হলেও ‘১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের সাফল্যের পর ভারতীয় বিপ্লবীরা নতুনভাবে স্বাধীনতার গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। নির্বাসিত ভারতীয় বিপ্লবীরা সোভিয়েত সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং বিপ্লবীদের পুনঃসংগঠিত হতে সাহায্য করেন।’ কাজী নজরুল এ সময় করাচী সেনা ব্যারাকে কর্মরত ছিলেন। তিনি বরাবরই বিপ্লবের খবর রাখতেন এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ শুনতেন। এক সময় তিনি ফৌজ হতে ফিরে আসেন। তখন তার দেহে সৈনিকের উদ্যম আর মনে দেশপ্রেমের বর্ণিল আভা। ভারতে তখন অসহযোগ আন্দোলন ও খিলাফত আন্দোলনের প্রবাহ। এমন যুগসন্ধিক্ষণেই ‘নবযুগ’-এর আত্মপ্রকাশ। এ পত্রিকাটি কৃষক ও শ্রমিকের পক্ষে লিখে জনমত তৈরি করাসহ এদের শক্তিকে স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করেন। নবযুগ প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পাশাপাশি নজরুলের বলিষ্ঠ লেখার কারণে পত্রিকাটি ব্রিটিশ শাসকদের জন্য ভয়ের কারণ হয়েও দেখা দেয়। কারণ নবযুগে প্রথম থেকেই অত্যাচারী ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করতে রাজনৈতিক প্রবন্ধ লেখা শুরু হয় এবং সমানভাবে তুলে ধরা হয় মেহনতী মানুষের দাবির কথা। ফলে পত্রিকাটি ব্রিটিশ সরকারের রোষে পড়ে এবং জামানতের এক হাজার টাকা বাজেয়াপ্ত হয়। জনসমাজে উপেক্ষিত কৃষক-মজুরদের প্রতি নজরুলের অসাধারণ মমত্ববোধ ও তাদের শক্তির উপর গভীর ও অবিচল আস্থার কথা ‘নবযুগে’ প্রকাশিত বিভিন্ন প্রবন্ধে পাওয়া যায়। তিনি ‘ধর্মঘট’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, “....নিজেরা ‘মজা-সে’ ভোগের মধ্যে থাকিয়া কুলি-মজুরের আবেদন নিবেদনকে বুটের ঠোক্কর লাগাইতেছেন। সবার অন্তরে একটা বিদ্রোহের ভাব আত্ম-সম্মানের স্থূল সংস্করণ রূপে নিদ্রিত থাকে, যেটা খোঁচা খাইয়া খাইয়া জর্জরিত না হইলে মরণকামড় কামড়াইতে আসে না। কিন্তু ইহাতে এই মনুষ্যত্ববিহীন ভোগ-বিলাসী কর্তার দল ভয়ানক রুষ্ট হইয়া উঠেন, তাঁহারা তখনও বুঝিতে পারেন না যে, এ অভাগাদের বেদনার বোঝা নেহাৎ অসহ্য হওয়াতেই তাহাদের এ-বিদ্রোহের মাথা ঝঁকানি। উন্নত আমেরিকা-ইউরোপেই ইহার প্রথম প্রচলন। সেখানে এখন লোকমতের উপরই শাসন প্রতিষ্ঠিত, এই গণতন্ত্র বা ডেমোক্রেসিই সে দেশে সর্বেসর্বা; তাই শ্রমজীবী দলেরও ক্ষমতা সেখানে অসীম।” নবযুগে প্রকাশিত এমন অগ্নিঝরা ও জ্বালাময়ী প্রবন্ধের মাধ্যমে নজরুল ইসলাম ইংরেজ সরকারের বিষ নজরে পড়বেন এটাই স্বাভাবিক। কারণ তৎকালীন ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে ভেতরে ভেতরে সবাই যখন তোষামোদকারী তখন নজরুলের এই বাণীভঙ্গিই বলে দেয় তিনি তোষামোদের দলে নেই। এই জ্বালাময়ী লেখনীর কারণে ইংরেজ সরকারের পক্ষ থেকে নবযুগের মালিককে সতর্ক করে দেয়া হয়। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মালিক ফজলুল হকের সঙ্গে শুরু হয় কাজী নজরুল ইসলাম ও তার অন্যতম সহযোদ্ধা মুজফ্ফর আহমেদের রাজনৈতিক মতপার্থক্য। এই মতপার্থক্যই একসময় চূড়ান্ত বিভেদ সৃষ্টি করে। প্রায় ৮ মাস কাজ করার পর ‘নবযুগ’ ছেড়ে দিয়ে নজরুল ইসলাম কুমিল্লা চলে আসেন। মোহাম্মদ আকরম খাঁ ‘সেবক’ নামে একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করেন ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে। সাহসী সাংবাদিকতা ও পত্রিকার কাটতি বাড়াতে এ সময় নজরুলকে সহকারী সম্পাদক নিযুক্ত করা হয়। কাজী নজরুল তখন কুমিল্লায় ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। ‘সেবক’-এ নজরুলের কাজ সম্পর্কে আবুল কালাম শামসুদ্দীন বলেন, ‘নজরুল ইসলামের প্রতিভার ছোঁয়ায় ‘সেবক’-এর চেহারা নবরূপ দৈনিক কাগজের পাঠকদের আগ্রহ দৃষ্টি আকর্ষণ করল। বিশেষ করে সংবাদসমূহের হেডিংয়ের কবিতাময় রূপটাই সংবাদপত্র পাঠকদের মনকে আকর্ষণ করল বিশি।’ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও যে নজরুল কোন আপোস করেননি তা সেবক-এ চাকরিকালীন সময়ে আরেকবার প্রমাণিত হয়। ১৯২২ সালের ২৫ জুন সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মৃত্যু উপলক্ষে নজরুল ‘সেবক’-এ প্রকাশের জন্য যে দীর্ঘ সম্পাদকীয় রচনা করেন তা নজরুলকে না জানিয়েই কাটছাঁট করে প্রকাশ করা হয়। এমনকি লেখার ভাবও বদলে দেয়া হয়। নজরুল এটাকে কোনভাবেই মেনে নিতে পারেননি। অন্তরে সাম্যবাদ লালন করা নজরুল এ ঘটনায় ‘হিন্দু-মুসলিম’ বিভেদের স্বরূপ দেখতে পান। তিনি এ ঘটনার প্রতিবাদ করলে মালিকের সঙ্গে তার মতবিরোধ চূড়ান্ত পর্যায় পৌঁছে। তখন নজরুল এ পত্রিকা থেকে ইস্তফা দেন। সেবক ছাড়ার পর নজরুল নিজেই একটি পত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনা করেন। এ সময় চট্টগ্রামের হাফিজ মসউদ নামের জনৈক ব্যক্তি একটি বাংলা সাপ্তাহিক প্রকাশের প্রস্তাব নিয়ে মুজফ্ফর আহমদ ও নজরুলের সঙ্গে সাক্ষাত করেন। মাত্র আড়াইশ টাকা সম্বল করে ১৯২২ সালের ১১ আগস্ট অর্ধ-সাপ্তাহিক ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা প্রকাশ করেন তিনি। ‘নবযুগ’-এ সাংবাদিকতা করার সময়ই বিপ্লবী সাংবাদিকতার প্রদর্শক হিসেবে নজরুলের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ‘ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে, সামাজিক বৈষম্য সম্পর্কে মানুষের বিবেককে জাগ্রত করতে, সকল অসাম্যের বিরুদ্ধে বিপ্লবী মানসিকতা গঠনে এ পত্রিকার অবদান অনস্বীকার্য।’ ফলে ধূমকেতু নিয়ে নজরুলকে আলাদাভাবে ভাবতে হয় না। ধূমকেতু প্রকাশের পর বাংলার জাতীয়তাবাদী বিপ্লবীদের, সাম্যবাদী চিন্তাধারার মানুষের সমর্থন লাভ করে। মুজফফর আহমদও এ পত্রিকায় ‘দ্বৈপায়ন’ ছদ্মনামে লিখতেন। কাজী নজরুল ইসলামের আহ্বানে ধূমকেতু পত্রিকার প্রকাশলগ্নে কবি, সাহিত্যিক, বিপ্লবীরা আশীর্বাণী পাঠিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও একটি আশীর্বাণী পাঠান। তিনি লিখেছিলেনÑ ‘আয় চলে আয়, রে ধূমকেতু,/আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু,/দুর্দিনের এই দুর্গশিরে/উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন!....’ ‘ধূমকেতু’র মাধ্যমে নজরুলের সাংবাদিক-প্রতিভার সর্বাপেক্ষা আশ্চর্য স্ফুরণ ঘটে। প্রবন্ধের পৃষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাণী লেখা ‘ধূমকেতু’ পত্রিকাটি কেনার জন্য মোড়ে মোড়ে তরুণের দল দাঁড়িয়ে থাকত। বিক্রির সংখ্যা ক্রমশই বাড়তে থাকলে গ্রাহকরা আগাম টাকা দিয়ে রাখত হকারকে। কারণ ধূমকেতুর সাংবাদিক নীতি-আদর্শ ছিল ‘অর্ধ-চেতন’দের ঘা মেরে জাগিয়ে তোলা, অর্থাৎ গণজাগরণমূলক। যার কেন্দ্রীয় উদ্দেশ্যটি ছিল ব্রিটিশ শাসনের অবসান। নজরুল বিশ্বাস করতেন ব্রিটিশদের বিতাড়ন করা না গেলে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙা যাবে না। আর এর জন্য প্রয়োজন গণজাগরণ সৃষ্টির মাধ্যমে সশস্ত্র বিপ্লবে অংশগ্রহণ। ধূমকেতু জাতির অচলায়তন মনকে জাগিয়ে তুলতে, বাঙালী সমাজকে বৈপ্লবিক চিন্তাধারায় উদ্দীপ্ত করতে সহায়ক হয়। শুধু কাজী নজরুল কিংবা মুজফফরই নন, ধূমকেতুতে তৎকালীন সময়ের বাঘা বাঘা বিপ্লবীরাও লিখতেন। এদের মধ্যে ছিলেন শিবরাম চক্রবর্তী, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, প্রবোধচন্দ্র সেন, হুমায়ুন কবির, হেমেন্দ্রকুমার রায়, বলাইদেব শর্মা, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, কোটালিপাড়ার বীরেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, সাবিত্রী প্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন প্রমুখ। ধূমকেতুতে বিপ্লবাত্মক রচনার পাশাপাশি বিভিন্ন বিপ্লবীর ছবি ও তার বৈপ্লবিক কর্মকা-ের অংশবিশেষও প্রকাশ করা হতো। প্রকাশিত ছবিগুলো তরুণ সমাজকে বিপ্লবী ভূমিকায় উদ্বুদ্ধ করতে সহায়ক হয়েছিল। ধূমকেতুর সাহসী লেখনীর কারণে কিছুদিনের মধ্যেই রাজশক্তি প্রমাদ গুনতে শুরু করল। এ সময় ধূমকেতুর প্রকাশনাকে স্বাগত জানিয়ে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এবং বিভিন্ন পত্রিকা ইতিবাচক মন্তব্য করে। পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় ‘ধূমকেতু’ এবং কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে লিখেনÑ “....একদিন এলো একটি অপরিচিত তরুণ, বয়স আঠারো কি বিশ। মেঝের এক কোণে চুপ করে বসেছিল। চায়ের ভাঁড় এগিয়ে বললেÑ ‘চা খাই না’, আত্মপরিচয়ে যুবক জানালে তার নাম গোপীনাথ সাহা। সে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিতে চায়, পথের নির্দেশ ও প্রেরণা লাভের জন্যেই সে ‘ধূমকেতু’-র আখড়ায় এসেছে। পথ নির্দেশ বা প্রেরণা দেয়ার আখড়া এটা নয়, প্রাণের প্রাচুর্য ঘোষণা করার এবং অন্যায় অত্যাচারের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে দেয়াই ‘ধূমকেতু’-র ব্রত। আর তার ব্রত ভাঙনের জয়গান গাওয়া।” এছাড়া তৎকালীন ‘হিতবাদী’, সাপ্তাহিক ‘বিজলী’, ‘সত্যবাদী’ ও প্রধান বাংলা দৈনিক ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকায় ‘ধূমকেতু’ ও নজরুল সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য প্রকাশ করে। মূলত ধূমকেতুর মাধ্যমেই নজরুলের বিদ্রোহী সত্তার প্রকাশ সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ‘দিনের পর দিন তিনি যেমন সমাজের জড়তা ও অন্ধতা দূর করার উদ্দেশ্যে প্রবলভাবে আঘাত হেনেছেন, তেমনি বিদেশী রাজশক্তির বিরুদ্ধে গণবিপ্লবের উদ্বোধনার্থে অগ্নিগর্ভ বাণী প্রচার করেছেন’ ধূমকেতুর মাধ্যমে। পাঠকপ্রিয়তার মাপকাঠিতে ‘ধূমকেতু’, ‘বিজলী’, ‘শঙ্খ’ ও ‘আত্মশক্তি’কে ছাড়িয়ে যায়। কবিতা, প্রবন্ধ, হাস্যকৌতুক ইত্যাদি মধ্য দিয়ে একদিকে শাসক শ্রেণীর অত্যাচার, অবিচার ও শোষণ এবং অপরদিকে হিন্দু-মুসলমান সমাজের জড়তা, দুর্নীতি ও ভ-ামির বিরুদ্ধেও কলম ধরেন নজরুল। সম্পাদকীয় প্রবন্ধ হিসেবে ধূমকেতুর প্রবন্ধগুলো অতিমাত্রায় কাব্য-গুণান্বিত। এগুলোতে আবেগের তুলনায় বিচার-বিশ্লেষণের উপস্থিতি কম হলেও দেশের যৌবন-রক্তে এই সব দুঃসাহসী ও নির্ভীক প্রবন্ধ যে আবেগ ও উদ্দীপনার অগ্নি সঞ্চার করেছিলÑ তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। সংবাদের হেডিং প্রণয়নে মাঝে মাঝে রঙ্গ-ব্যঙ্গের ছোট ছোট কবিতা ও প্যারোডির ব্যবহারের ফলে সংবাদগুলো হতো উপভোগ্য ও মর্মস্পর্শী। কথ্যভাষায় আরবী, ফারসী, দেশী শব্দের নিপুণ প্রয়োগে সেগুলো হতো তীক্ষè ও প্রাণবন্ত। নিঃসন্দেহে বলা যায়, সাংবাদিক জীবনের নিষ্ঠা, কর্তব্যজ্ঞান, নির্ভীকতা ইত্যাদি সদগুণের দুর্লভ সমাবেশ ঘটেছিল নজরুলের মধ্যে। নবযুগ ও ধূমকেতু ছাড়াও স্বরাজ পার্টির মুখপত্র ‘লাঙল’, ও ‘গণবাণী’ পত্রিকায় নজরুল সাংবাদিকতা করেছেন। এরপর নজরুল দীর্ঘদিন পত্রিকা সম্পাদনা থেকে নিজেকে বিরত রাখেন। চল্লিশের দশকে অবিভক্ত বাংলার প্রধান পুরুষ একে ফজলুল হক ‘নবপর্যায়ে নবযুগ’ প্রকাশ করলে অনেক পীড়াপীড়ি ও আর্থিক সঙ্কটের কারণে নজরুল এ পত্রিকায় সাংবাদিকতা করতে সম্মত হন। ‘নবযুগ’ দিয়ে তার সাংবাদিকতা জীবনের শুরু হয় আবার এই ‘নবপর্যায়ে নবযুগ’ পত্রিকার মাধ্যমেই তার সাংবাদিকতার পরিসমাপ্তি ঘটে। পরিশেষে বলা যায়, সাংবাদিকতার ইতিহাসে কাজী নজরুল ইসলাম যে বিপ্লবী চেতনার উন্মেষ ঘটিয়েছিলেন তা যেমন বিস্মৃত হওয়ার নয়; তেমনি গণমানুষের চেতনা জাগাতে তার সাহিত্যের পাশাপাশি সম্পাদকীয় রচনাসমূহের ঐতিহাসিক গুরুত্ব কোন অংশে কম নয়।
×